ঈদুল আজহার আগে-পরে আট দিন শিথিল রাখার পর সরকার আবার ১৪ দিনের কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করেছিল, কিন্তু এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই আট দিনের মাথায় গতকাল শুক্রবার রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। সরকারি ছুটির দিনেই এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কঠোর বিধি-নিষেধ শেষ হবে আগামী ৫ আগস্ট।
দেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ঈদের ছুটির আগেই আশা করেছিলেন সরকার এই খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে আগামী ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলার সুযোগ দেবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যে এই তারিখে কারখানা খোলা হতে পারে, তাঁরা যেন সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। এই বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান চিঠিও দেন সদস্য কারখানাগুলোকে। অবশেষে তাঁদের সেই আশা পূরণ হলো।
তবে হঠাৎ সরকারের এই সিদ্ধান্তে ঈদের সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া শ্রমিকদের আবার ঢাকামুখী ঢল নামার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ আজ শনিবার এক দিনের মধ্যে তাঁদের ঢাকায় আসতে হবে। পরিবহন বন্ধ থাকায় তাঁরা কিভাবে আসবেন, সেই নির্দেশনা নেই।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন করোনা মোকাবেলায় সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা। এমনকি কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে আজ-কালের মধ্যেই ওই কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে পারেন বলে আভাস দিয়েছেন।
তবে এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা ঈদের পরের দিন এবং এই কয়েক দিনে বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকায় এসেছেন বা এরই মধ্যে কারখানার আশপাশে রয়েছেন, শুধু তাঁদের নিয়েই কারখানা চালু করবেন গার্মেন্ট মালিকরা। আর যাঁরা বাড়িতে অবস্থান করছেন তাঁরা ৫ আগস্টের পর গাড়ি চলাচল শুরু হলে ঢাকায় আসবেন।’ প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গার্মেন্ট মালিকরা আমাদের কথা দিয়েছেন বাড়িতে অবস্থানরত শ্রমিকদের কারখানায় আসতে চাপ দিবেন না তাঁরা। আমরা কঠোরভাবে বলেছি, এই সময়ের মধ্যে কোনো বাস চলবে না। যাঁরা রয়েছেন তাঁদের নিয়েই স্বল্প পরিসরে কাজ করতে হবে। শিল্প-কলকারখানার মালিক এবং তাঁদের সংগঠনগুলো এই শর্ত মেনে নিয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম গতকাল সকালেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকায় চলমান কঠোর বিধি-নিষেধ আরো ১০ দিন অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কমিটিতে থেকে লাভ কী? যে পরামর্শ দিই সেটা তো একবারও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হলো না। মহলবিশেষ সরকারকে চাপের মুখে ফেলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশৃঙ্খলার মুখে ফেলছে। এর দায় গিয়ে তো সরকারের ওপরেই পড়ছে। সরকার কেন ৫ আগস্টের আগেই হুট করে শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিল, তা বোধগম্য নয়।’
আরেক সদস্য বলেন, এই যে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হলো, এখন যে লাখ লাখ শ্রমিক ঢাকার বাইরে আছেন তাঁরা তো সব ঢাকায় ছুটবেন, মানুষের ঢল নামবে, সীমাহীন ভোগান্তির মুখে পড়বে লাখো মানুষ। এটা তো ঠেকানো যাবে না। এর মাধ্যমে সংক্রমণ তো আরো বেড়ে যাবে। তাহলে লাভ কী হলো?
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় দাবি জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার থেকে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে।
গতকাল বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে রপ্তানিমুখী শিল্প খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ১ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্প ও কলকারখানা আরোপিত বিধি-নিষেধের আওতাবহির্ভূত রাখা হলো।
এর মাধ্যমে ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে বদল এলো। গত ১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ঈদের এক দিন পর অর্থাৎ ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিনের টানা কঠোর বিধি-নিষেধ বা লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। ঈদের পর শুরু হওয়া লকডাউনের মধ্যে ব্যবসায়ীরা কয়েক দফা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাকে লকডাউনের বাইরে রাখার আবেদন জানান। কিন্তু সরকার বরাবরই কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
সার্বিকভাবে লকডাউন পরিস্থিতি মূল্যায়নে গত রবিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেও ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদসচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, উচ্চ পর্যায়ের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী কর্মকর্তা, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), বিজিবির ডিজিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে নিল সরকার। এর কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র কালের কণ্ঠকে বলেন, আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত নানা যৌক্তিক কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে অন্য ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের কঠোরতা বজায় থাকবে।
করোনা মোকাবেলায় সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে অন্ততপক্ষে আমাদের সঙ্গে সরকারের আলাপ করা উচিত ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের জায়গা থেকে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন যেটা হবে তাহলো সংক্রমণ পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবে আরো ঊর্ধ্বমুখী হবে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে আমরা একটি বৈঠক ডাকব।’
কমিটির একাধিক সদস্যের পদত্যাগের আভাস দেওয়ার বিষয়ে ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘কোনো কোনো সংক্ষুব্ধ সদস্য আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে আরো কথা বলব। আশা করি, তাঁরা পরিস্থিতি বুঝবেন।’
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের আশা পূরণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড় ধরনের সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন। এর ফলে দেশের রপ্তানি খাত বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে বেঁচে গেল। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।’
ফারুক হাসান বলেন, কারখানায় আসার সুযোগ থাকলে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবেন। কেউ গ্রামে চলে গেলে লকডাউনের পর কাজে যোগ দিতে পারেন। কারো চাকরি যাবে না। ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত হবেন না। তিনি আরো বলেন, ‘কারো চাকরি গেলে আমাদের জানাবেন। আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।’ কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালুর জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আকতার কালের কণ্ঠকে বলেন, হঠাৎ কারখানা খুলে দেওয়ার সরকারের এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা আবারও সংকটে পড়ে গেলেন। তিনি আরো বলেন, যাঁরা ছুটিতে গ্রামে চলে গেছেন তাঁদের এখন কী হবে? তাঁরা এখন মজুরিও হারাবে, একই সঙ্গে চাকরি যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। গত বছর কারখানা হঠাৎ খুলে দেওয়ায় শ্রমিকরা হেঁটে ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে এসে কারখানায় যোগ দিলেও কোনো ঝুঁকি ভাতা বা যাতায়াত ভাতা পাননি। এবারও মালিকদের সুবিধা দিলেও শ্রমিকরা বরাবরের মতো বঞ্চিত হবেন। শ্রমিকদের এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।